মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদ-াদেশের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল আবেদন বুধবারের কার্যতালিকায় এসেছে।
এদিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৪ বিচারপতির বেঞ্চে মামলা দুটি আদেশের জন্য ২ ও ৩ ক্রমিকে রয়েছে।
তবে শুনানি মুলতবি করতে আসামিপক্ষের দু’টি আবেদনও এসেছে কার্যতালিকায়। ওই দু’টি আবেদনও আদেশের জন্য রয়েছে।
প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন-বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসাইন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
গত বুধবার আপিল দুটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকার ৮ ও ৯ নম্বরে ছিল। তবে মামলা দুটি আদালতে ওঠার আগেই আপিল বিভাগের দিনের শুনানির সময় শেষ হয়ে যায়।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের নয়টি মামলা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা এসব মামলার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় পাঁচজনের, বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজনের, জাতীয় পার্টির দুই নেতার এবং আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের সাবেক এক নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।
দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায়ে এই নয়জনের মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদ-াদেশ এবং একজনকে আমৃত্যু কারাদ-াদেশ দিয়েছেন।
এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আশা করছেন, চলতি বছর আরও কয়েকটি মামলার আপিল নিষ্পত্তি হতে পারে। গত রোববার নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে কি না, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার। আর ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির সাজা কমিয়ে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদ- দেন আপিল বিভাগ। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি।
দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধের আরও পাঁচটি মামলায় নয়জনের বিচার চলছে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১-এ তিনটি ও ট্রাইব্যুনাল-২-এ দুটি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে। এই নয় আসামির কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের বা কেন্দ্রীয় নেতা নন।
আপিলে থাকা নয় মামলা: মুজাহিদের বিরুদ্ধে মামলাটি ছাড়া আপিল বিভাগে জামায়াতের অন্য যে চারজন শীর্ষ নেতার আপিল বিচারাধীন রয়েছে তাঁরা হলেন দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী। ট্রাইব্যুনাল তাঁদের সবাইকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
আপিল নিষ্পত্তির তালিকায় রয়েছে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সৈয়দ মো. কায়সারের বিরুদ্ধে মামলাটিও। সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী কায়সারকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদ-াদেশ দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেন। জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ পলাতক আবদুল জব্বারকে বয়সের বিবেচনায় আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। পলাতক থাকায় জব্বার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেননি। তবে রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জব্বারের ফাঁসি চেয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোবারক হোসেনের মামলাও আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ফাঁসির আদেশ দিলে তিনি খালাস চেয়ে আপিল করেন।
বিচারাধীন অবস্থায় দুজনের মৃত্যু: আপিল বিভাগে মামলা বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও বিএনপির নেতা আবদুল আলীম। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই গোলাম আযমের বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় তাঁকে ৯০ বছরের কারাদ-াদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। একই বছরের ৯ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও বয়স বিবেচনায় আলীমকে আমৃত্যু কারাদ- দেন ট্রাইব্যুনাল-২। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ আপিল করে। আপিলে রাষ্ট্রপক্ষ চায় ফাঁসি, আসামিপক্ষ চায় খালাস। এ দুটি আপিল নিষ্পত্তির আগেই গত বছরের ৩০ আগস্ট মারা যান ৮৪ বছর বয়সী আবদুল আলীম, ২৩ অক্টোবর মারা যান গোলাম আযম। ফলে এ দুটি আপিলই বাতিল করা হয়েছে।
এদিকে জামায়াতের আরেক নায়েবে আমির এ কে এম ইউসুফ মারা যান ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারাধীন অবস্থায়। গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ৮৯ বছর বয়সী ইউসুফ মারা যান। তখন তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি যুক্তি উপস্থাপনের পর্যায়ে ছিল। তাঁর মৃত্যুতে ওই মামলা বাতিল করেন ট্রাইব্যুনাল।
পলাতক আরও চারজন: জাতীয় পার্টির আবদুল জব্বার ছাড়াও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দ-াদেশপ্রাপ্ত আরও চার আসামি পলাতক রয়েছেন। তাঁরা হলেন জামায়াতের সাবেক রুকন (সদস্য) আবুল কালাম আযাদ, ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপির নেতা এম এ জাহিদ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধকালে আলবদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। ট্রাইব্যুনাল রায়ে এঁদের সবাইকে মৃত্যুদ-াদেশ দেন। পলাতক থাকায় তাঁরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেননি, তাঁদের মৃত্যুদ-ও কার্যকর করা যায়নি।
Leave a Reply