চাঁদপুরের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি ডাক্তার ও ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপহার বাণিজ্য থেমে নেই। এ বিষয়ে চাঁদপুর নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে শহরে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়।
বিষয়টি নিয়ে পুনরায় অনুসন্ধানে গিয়ে চাঁদপুর সরকারি ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে দেখা গেছে অভিনব চিত্র। হাসপাতালের বারান্দায় ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের রাখা মোটর সাইকেলগুলো দু’পাশে একের পর এক সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে করে রোগীদের ট্রলি নিয়ে আসা-যাওয়ায় ব্যাপক কষ্ট হচ্ছে। এ ব্যাপারে ক’জন রোগীর অভিভাবকদের উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা গেলো। দ্রুত রোগী বহনের জন্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে হাসপাতালের অভ্যন্তরের করিডোরে রাখা এ মোটর সাইকেলগুলো।
এসব পেরিয়ে যখন জরুরি বিভাগে যাওয়া হলো তখন দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। রোগীদের প্রচুর ভিড়। অথচ ডা. হামিমা আক্তার ও ডা. মাহবুব আলম দু’জনে বসে খোশগল্প এবং হাসি ঠাট্টা করছেন। কিছুণ পর দু’তিনজন ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি এসে ডাক্তারদের সাথে কথাবার্তায় যোগ দেন এবং একজন প্রতিনিধি ডাক্তার মাহবুব আলমকে ঔষদের স্যাম্পল ও উপহার সামগ্রী প্রদান করেন।
এদিকে এক বৃদ্ধ রোগী রোগের যন্ত্রণায় যখন কাতরাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন, ‘ডাক্তার সাহেব আমি মরে যাচ্ছি; আমাকে একটু দেখুন।’ তখন ডাক্তার হামিমা বেশ উত্তেজিত হয়ে ওই রোগীকে বলেন, ‘কথা কম বলেন, বেশি কথা বললে এক থাপ্পড় দিয়ে রোগ ভালো করে দিবো।’ এ সময় এ প্রতিবেদক ছবি তুলতে গেলে ডাক্তার হামিমা এ প্রতিবেদকের দিকে গালমন্দ করে তার ক্যামেরা কেড়ে নিতে চান এবং বলেন, আপনাকে কে ছবি তোলার অনুমতি দিয়েছে? আপনি পরিচয় না দিয়ে কেনো ছবি তুলছেন। এসব কথার বলার পর প্রতিবেদকের ক্যামেরা কেড়ে নিতে না পারলে ডাক্তার হামিমা তাকে গালমন্দ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে যান। সেই সাথে ডাক্তার মাহবুব আলমও বেরিয়ে গিয়ে তাদের পরিচিত ক’জন দালালকে ডেকে আনেন। ওই দালালরা প্রতিবেদককে জোর করে বাইরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়, আর বলে আর কখনো হাসপাতালের কোনো বিষয় নিয়ে ছবি বা নিউজ হলে আমরা ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলবো।
এ সময় চাঁদপুর ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ লতিফ, সাধারণ সম্পাদক কে এম মাসুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুন শেখ আল মামুনসহ অন্যান্য সাংবাদিকবৃন্দ খবর পেয়ে ছুটে এসে দেখতে পান ডাক্তার হামিমা খুব উত্তেজিত হয়ে গালমন্দ করছেন সাংবাদিকদের। এ সময় বিএমএ চাঁদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহমুদুন নবী মাসুম, আরএমও সিরাজুল ইসলামসহ অনেক ডাক্তার ছুটে আসেন এবং ডাক্তার হামিমাকে পাগল অভিহিত করে ডাক্তার মাহমুদুন নবী মাসুম সাংবাদিকদের সান্ত্বনা দেন এবং বিষয়টি দু’একদিনের মধ্যে ফয়সালা করবেন বলে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দকে জানান।
এদিকে চাঁদপুরের বেশিরভাগ এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে অধিকাংশ ডাক্তারের চেম্বারেই পূর্বের মতোই ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভীড়। রোগী দেখার পাশাপাশি ডাক্তারদের চেম্বার ভিজিট করে ঔষধ স্যাম্পল দেয়া, উপহার প্রদান করে নিজেদের ঔষধ প্রেসক্রাইব করার ব্যাপারে তারা থাকছে সচেষ্ট। চাঁদপুরে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে কোনো নজরদারি বা আইনী পদপেও চোখে পড়ছে না। ফলে চাঁদপুরে এক প্রকার নির্ভিঘেœই চলছে ডাক্তার ও ঔষধ কোম্পানিদের প্রতিনিধিদের ঔষধ স্যাম্পল, উপহার-উপঢৌকন বাণিজ্য। সেই সাথে রোগীরা পাচ্ছে নিম্নমানের অকার্যকর ঔষধের প্রেসক্রিপশন, যা দিয়ে রোগীদের রোগ নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা উল্টো ফল বয়ে আনছে।
এ বিষয়ে বিএমএ চাঁদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহমুদুন নবী মাসুমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আসলে অখ্যাত কোনো কোম্পানি বলতে কিছু নেই। বাংলাদেশে যে কোম্পানিগুলো কাজ করে সেগুলো সরকারের রেজিস্ট্রেশনকৃত কোম্পানি। সরকারের ড্রাগ অ্যাডমিনিস্টেশন দ্বারা ওইসব কোম্পানিগুলো ঔষধ বাজারজাত করার সুযোগ পায়। তারা তাদের ঔষধ ও যন্ত্রপাতির মান পরীা করেই তাদের লাইসেন্স প্রদান করে। একটা কোম্পানির ঔষধ জনসাধারণ খাবে কি-না সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের ড্রাগ অ্যাডমিনিস্টেশনের। যেহেতু সরকার বা সরকারের দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠান তাদের লাইসেন্স দিয়েছে তাই তাদের আমরা অখ্যাত কোম্পানি বলতে পারি না। আর সেই সব কোম্পানির ঔষধ ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশনে লিখলে তাদের সেটা অন্যায় কিছু হবে না। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এখন হচ্ছে প্রচারেই প্রসার। অনেক কোম্পানির ভালো ভালো ঔষধ আছে কিন্তু তাদের প্রচার বা মার্কেটে লোকজন না থাকায় তাদের ঔষধগুলো চলে না। উপঢৌকন দিয়ে ডাক্তারদের প্রলুব্ধ করে প্রেসক্রাইব করার ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা এক ধরনের মার্কেটিং পলিসি। এখনকার যে গ্লোবাল মার্কেটিং পলিসি তাতে দেখা যায় সেটা শুধু ডাক্তারদের বেলায়ই নয়, বরং যেমন টিচারদের বেলায় দেখুন, ভালো ভালো প্রকাশনী টিচারদের স্যাম্পল বই দিয়ে সেটা তার কাছে ভালো লাগলে ওই টিচার তা ছাত্রদের পড়ার জন্যে সিলেক্ট করেন এবং কিনতে বলেন। যেমন একজন হজ্বে যাবে, এইসব হাজীদেরকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কোম্পানি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের প্যাকেট গ্রহণ করতে বলেন। এটা হচ্ছে মার্কেটিং পলিসি, এেেত্র ডাক্তাররা হয়তো কিছুটা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন, তবে তারা তাদের ইচ্ছেমতো যেটা রোগীর জন্যে ভালো হবে সেই ঔষধই প্রেসক্রাইব করেন।
Leave a Reply